November 21, 2024, 8:34 am
কানন দেবী বাঙালি অভিনেত্রী এবং গায়িকা। তিনি কানন বালা নামেও পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়িকাদের মধ্যে প্রথম গায়িকা এবং বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম তারকা হিসেবে স্বীকৃত। সাধারণত দ্রুত লয়ে তার গান গাওয়ার ধরন নিউ থিয়েটার, কলকাতার ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বহু প্রতিভার কানন দেবী অভিনয়ের পাশাপাশি নৃত্য এবং সঙ্গীতেও ছিলেন পারদর্শী। প্রায় ৭০-এর অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়াও বিজ্ঞাপন চিত্রেও দেখা যায় তাকে। কানন দেবীর আত্মজীবনী সবারে আমি নমি। শিল্প মাধ্যমে অসাধারণ অবদানের জন্যে ভারত সরকার তাকে ১৯৬৪ সালে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
কানন দেবীর ১৯১৬ সালের ২২ এপ্রিল হাওড়া, বেঙ্গল, ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নেন। তিনি ছিলেন একজন রক্ষিতার সন্তান। তার বাবা রতন চন্দ্র দাস ছিলেন সওদাগর অফিসের কেরানি। তার বাবার একটি ছোট দোকানও ছিলো। নয় বছর বয়সে কাননের বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর কাননের মা তার দুই কন্যাকে নিয়ে এক দূর সম্পর্কের আত্নীয়ের বাড়িতে রাঁধুনী ও ঝিয়ের শুরু করেন। তাই তারা অসম্ভব দারিদ্র্যের মাঝে একটি ছোট বাসা ভাড়া নেন। দরিদ্রতার কারণে কানন মাত্র বার-তের বছর বয়সেই ম্যাডানের স্টুডিওতে হাজির হন অভিনয় করতে। এবং সেই সময়েই নির্বাক চলচ্চিত্র জয়দেবে (১৯২৬) অভিনয় করেন।
১৯২৬ সালে জয়তিশ বন্দোপাধ্যায়ের জয়দেবে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে কানন দেবীর অভিনয়ের শুরু হলেও তার সত্যিকারের অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। মূলত দরিদ্রতার কারণে কিশোর বয়স থেকেই তাকে পর্দায় নগ্নতার দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়েছে। ১৯৩১ সালে জয়তিশ বন্দোপাধ্যায়ের জোর বরাত পূর্ণাঙ্গ সবাক চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে নায়ক তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোটে চুমু খাওয়ায় তিনি অপমানিত ও ব্যথিত বোধ করেন। যদিও পরিচালকের নির্দেশেই নায়ক তাকে না জানিয়েই এই কাজ করেছিলেন। অভিভাবকহীন নিম্নবিত্তের মেয়ে হওয়ায় নানাভাবে তাকে অর্থের লোভ দেখিয়ে নগ্ন দৃশ্যে অভিনেয়ের জন্যে বাধ্য করা হতো। ১৯৩৫ সালে সতীশ দাশগুপ্তের বাসব দত্তা চলচ্চিত্রে তার অনিচ্ছায় নগ্নতার প্রদর্শন ছিলো। এছাড়াও তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পরিচালকেরা অর্থিকভাবেও তাকে ঠকাতেন। ১৯৩৫ সালে মুক্তি পায় তার জয়তিশ বন্দোপাধ্যায়ের মানময়ী গার্লস স্কুল এবং এর মাধ্যমেই তিনি নিজেকে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর ১৯৩৭ সালে মুক্তি চলচ্চিত্র তাকে সর্বপ্রথম অভিনেত্রী হিসেবে সফলতা এনে দেয়।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কানন দেবীর জন্য সবচেয়ে বেশি খ্যাতির সময় ছিল। তিনি এ সময় সম্ভ্রান্ত কানন দেবীতে পরিণত হন কানন বালা থেকে। তিনি তখন রোমান্টিক নায়িকার বদলে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাতেই বেশি অভিনয় করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি শ্রীমতি পিকচার্স গড়ে তোলেন যার বেশির ভাগ ছবিই ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে। এই কোম্পানীর ছবিতে তিনি কেবল অভিনয় ও প্রযোজনাই করেন নি, তিনি পরিচালনাও করেন। তার ছবির পরিচালকের একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট দল ছিল যার নাম সব্যসাচী। তিনি তিন জনের একজন ছিলেন।
কানন দেবী একজন ভাল গায়িকাও ছিলেন। তিনি ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা নেন। এছাড়াও তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, অনাদি দস্তিদার ও পঙ্কজ কুমার মল্লিকদের কাছেও তালিম নেন। তিনি আধুনিক গান ছাড়াও রবীন্দ্র সঙ্গীতও গেয়েছিলেন, যা রবীন্দ্রনাথকেও খুশি করে তুলেছিল। এ গানকে তিনি ভদ্রঘর থেকে বাংলার সাধারণ ঘরেও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
কানন দেবী ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। চলচ্চিত্রে ইতিহাসবিদ রবি বসু লিখেছেন যে কানন বালাকে দেখে অনেক যুবক ও প্রৌঢ়েড় হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেত। রূপবাণী সিনেমা হলে এক উদ্ভ্রান্ত যুবক মোহগ্রস্ত হয়ে তার সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্যের সময় পর্দার দিকে ছুটে গিয়েছিল তাকে ধরতে।কলকাতার রাস্তায় চট বিছিয়ে তার আলোকচিত্র বিক্রি হত। মহিলারা তার ফ্যাশনে শাড়ি-ব্লাউজ পরা শুরু করেন। এমনকি কানের দুলও তৈরি করান তারা। কানন দেবী ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
Comments are closed.